গল্প

কুয়োর নিচে কে আছে ??

পর্ব ১ : অচেনা কুয়োর ফিসফাস

দূর মফস্বলের খনি অঞ্চলের এক স্কুলে সম্প্রতি চাকরি পেয়েছেন অভীক সেন, বয়স কেবল ছাব্বিশ। সদ্য শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেছেন। কলকাতা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট শহরের একমাত্র উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে তার নতুন যাত্রা শুরু।

স্কুলটির নাম — শান্তিপুর হাই স্কুল। এলাকায় একটাই বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় স্কুলটির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এই স্কুলের পরিকাঠামো খুবই খারাপ। অনেক শিক্ষকই বদলি নিতে চান, কারণ এখানকার পরিবেশ দুর্গম, খনির ধুলোর জন্য বাতাস ভারী, চারপাশে নেই কোনো উন্নত পরিকাঠামো।

অভীক স্কুল থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে, এক পুরোনো শিক্ষক কোয়ার্টারে এসে উঠেছেন। একতলা, খোয়াড় ছাওয়া, মেঝেতে ফাটল, দরজা জানালার কাঠে ঘুণ ধরেছে, চারপাশে জঙ্গল ঘেরা সেই কোয়ার্টারটিকে কেউ ‘বাসযোগ্য’ বলবে না।

স্থানীয় লোকেরা বলেন, “ওই কোয়ার্টারটা খুব পুরনো… আর অত ভালো কিছু ঘটেনি ওখানে। তবুও আপনি যদি কিছুদিন থাকতে চান, থাকুন।”

অভীক কোনো কথা বলেননি। শুধু মাথা নেড়েছেন। অস্থায়ীভাবে থাকছেন, যতদিন না স্কুলের আশেপাশে কোনও ভাড়ার ঘর খুঁজে পান।

জুলাই মাসের ভ্যাপসা গরম। সন্ধ্যাবেলা একটু হাওয়া ছিল, কিন্তু রাত ১১টা নাগাদ বিদ্যুৎ চলে গেছে পুরো এলাকায়। মোমবাতির আলোয় বসে থাকা যাচ্ছে না—ঘাম আর মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ অভীক অবশেষে ছাদে উঠে এলেন। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে আগুন ধরালেন।

নিচে রাস্তা একেবারে ফাঁকা। মাঝে মাঝে একটা-দুটো বাইক চলে যাচ্ছে, তাদের হেডলাইটের আলোয় রাস্তার ধুলো উড়ছে। দূরে মাইনের খনি এলাকার সাদা টাওয়ারটা হালকা আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

ছাদ থেকে স্কুল বিল্ডিংটা বেশ ভালো দেখা যায়। স্কুলের পিছন দিকে একটা ঘন আগাছা ভর্তি জায়গা, যার মাঝখানে আছে একটা পুরনো কুয়ো। কুয়োটার চারপাশ ঘেরা, কিন্তু ঘেরা মানে কেবল কিছু মরচে ধরা লোহার রেলিং। আগাছার মধ্যে কুয়ো প্রায় ঢাকা পড়ে আছে।

হঠাৎ অভীকের কানে আসে একটা “ফিসফিস…” শব্দ। সে চমকে ওঠে।

সিগারেট ঠোঁটে রেখেই সে চোখ কুঁচকে দেখে কুয়োটার দিকে। মনে হচ্ছে যেন কুয়োর ধারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে… না… ছায়া নাকি গাছ? ভালো বোঝা যাচ্ছে না।

শব্দটা আবার আসে—“আস…আসো… এখানে আসো…” অভীক এবার উঠে দাঁড়ায়। একটু থেমে শোনে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে তার বন্ধু সমীরের নাম।
“ভাই! পৌঁছে গেছিস? কী খবর? জায়গাটা কেমন?”
অভীক হেসে বলে, “জায়গাটা একদম জংলি। মনে হচ্ছে ভূতের সিনেমায় আছি!”

কথা বলতে বলতে অভীক কুয়োর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেলে। নিচে আর কোনও শব্দ নেই, শুধু রাতের কোলাহল। ব্যাঙ ডাকছে দূরে কোথাও। হাওয়া একেবারে স্তব্ধ।

ফোনে কথা বলতে বলতে অভীক নিচে নেমে আসে।


পর্ব ২ : হারিয়ে যাওয়া বল, খুঁজে পাওয়া সত্য

বেলা তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ক্লাস সেভেনের ছাত্র রিতম ক্লাসে ঢুকেই সোজা চলে এলো অভীক স্যারের টেবিলের সামনে। মুখে কিছুটা হাফ ধরা ভাব, কিন্তু চোখে কৌতূহল। “স্যার, আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম রিসেসে… বলটা স্কুলের পেছনের ঝোপের দিকে চলে গেছে। আমরা খুঁজতে চাই, কিন্তু রামধন দারোয়ান যেতে দিচ্ছে না।”

অভীক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে এলেন। স্কুলের পিছন দিকে একটা জঙ্গলাক্রান্ত এলাকা, আগাছা, কাঁটা গাছ, ছোট ছোট ঝোপে ভর্তি। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল সেই রাতে ছাদ থেকে দেখা কুয়ো আর সেই অদ্ভুত ফিসফিসে ডাক।

“রামধন দারোয়ান বলেছে যেতে দিচ্ছে না?”
“হ্যাঁ স্যার, বলেছে পিছনে গন্ধ, সাপ-খোপ থাকতে পারে… একদম মানা করেছে।”

অভীক এবার সরাসরি চলে গেলেন দারোয়ানের কাছে। বয়স ষাটের কাছাকাছি, গায়ের রং পুড়ে যাওয়া কুচকুচে কালো, মুখটা সবসময় গম্ভীর, নাম রামধন দাস। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “স্যার, ওইদিকে বাচ্চাদের যেতে দেবেন না। জায়গাটা একেবারে অজঙ্গল। আমি তো আছি বলেই স্কুলটা এখনো ঠিকঠাক। ওইদিকে গেলে সাপ কামড়ালে কী হবে?”

অভীক তার যুক্তি বুঝলেন, বললেন, “ঠিক আছে, বাচ্চারা যাবে না। আপনি আর আমি যাবো। একটা লাঠি আর গামবুটের ব্যবস্থা করুন।” রামধন একটু অবাক হলেও মাথা নেড়ে রাজি হলেন।

পনেরো মিনিটের মধ্যে দুজনেই তৈরি। পা পর্যন্ত গামবুট, হাতে মোটা বাঁশের লাঠি। ঝোপের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকতে শুরু করল তারা। ধুলোমাখা আগাছা ঠেলে, পোকামাকড়ের ভিড়ে পথ তৈরি করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলেন। মাটিতে জায়গায় জায়গায় সাদা ছত্রাক, শুকনো পাতা আর এক অদ্ভুত পচা গন্ধ ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ রামধন বললেন, “স্যার, এই তো বল! ওখানে পড়ে আছে।” একটা গাছের তলায় ময়লা জমা জায়গায় বলটা পড়ে আছে। অভীক বলটা তুলে নিলেন, কিন্তু তার নজর পড়ল আরেকটু সামনে একটা অদ্ভুত কিছুর দিকে।

একটা ছেঁড়া, ময়লাধরা পুরোনো স্কুল জুতো। পাশে পড়ে আছে একটা ছোট ব্যাজ—স্কুল ব্যাজ। তাতে স্কুলের নাম আর একটা নম্বর, “B-147”।

অভীক জুতোটা হাতে নিলেন। দেখে বোঝা গেল অনেকদিনের পুরোনো। ব্যাজটাও ধুলোয় ঢাকা। কিন্তু আশ্চর্যভাবে সেই নম্বরটা পরিষ্কার। বুকের মধ্যে হালকা ধাক্কা খেয়ে উঠল। “রামধনদা, এই জায়গাটা পরিষ্কার করা দরকার। এত আবর্জনা, ঝোপঝাড়… স্কুলের পিছনে এটা থাকা উচিত নয়।”
রামধন কিছু না বলে তাকিয়ে রইলেন।

সেই বিকেলেই অভীক বিষয়টি স্কুলের পরিচালন কমিটির হেড চন্দনবাবুর কাছে জানান। চন্দন ঘোষ, বছর পঞ্চাশের এক ধূর্ত ও জেদি মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন। স্কুলে তার কথাই শেষ কথা।

তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “স্যার, আপনি পড়ান। স্কুল চালানো আমাদের কাজ। এই জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে মিস্ত্রি, খরচ, লোক লাগবে। বাজেট নেই এখন। আর ওই জায়গায় তো কেউ যায় না… অযথা খরচ করে লাভ নেই।”

অভীক মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না।

পরদিন সকালে ক্লাস শুরুর আগে অভিভাবকদের কয়েকজনকে আলাদাভাবে ডাকলেন। কারও বাবা দোকানি, কারও মা স্কুলে কাজ করেন। তাদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন, ছাত্রদের নিরাপত্তা, খেলার মাঠের প্রয়োজন, স্কুলের মর্যাদা—সব তুলে ধরলেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই অভিভাবকরা মিলে লিখিতভাবে একটি চিঠি জমা দেন কমিটির কাছে। চন্দনবাবুর পক্ষে আর না বলার উপায় থাকল না। অপমানিত বোধ করলেন তিনি। মনেই মনেই অভীককে দোষ দিতে লাগলেন—”এই ছোকরা এখন থেকেই বেশি চালাকি করছে! স্কুলে নতুন এসেছে, আর আমার মাথার ওপর দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে?”

যাই হোক, এক সপ্তাহের মধ্যেই স্কুলের পিছনের ঝোপ কাটা শুরু হল। এলাকার কিছু পরিচিত শ্রমিক এনে কাজ চলল কয়েকদিন ধরে। আগাছা সরতেই দেখা গেল জায়গাটা বেশ বড়, প্রায় অর্ধেক ফুটবল মাঠের সমান। জায়গাটাকে সমান করে, চারপাশে ছোটো বেড়া দিয়ে তৈরি হল একটা অস্থায়ী খেলার মাঠ।

বাচ্চাদের আনন্দ দেখে কে! দৌড়ঝাঁপ, ফুটবল, ক্রিকেটে মেতে উঠল সকলে। আর তাদের মুখের হাসিই যেন অভীকের পুরস্কার হয়ে উঠল।

ছাত্রদের মধ্যে অভীকের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। সহকর্মীরাও প্রশংসা করতে লাগলেন। কিন্তু কেউ একজন যে চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে—তাকে কেউ দেখতে পায় না।

কমিটির প্রধান চন্দন ঘোষ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, “এই ছোকরাকে আমি ঠিকই দেখাব… ওর আসল জায়গা কোথায় তা বোঝাবো…”


পর্ব ৩ : হারিয়ে যাওয়া নামের সন্ধানে

মাঠে দাঁড়িয়ে অভীক কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাঁর হাতে সেই ছেঁড়া ব্যাচ, যার নম্বর স্পষ্টভাবে লেখা: B-147
এটা কোনো সাধারণ জিনিস নয় — কেউ নিজের ব্যাচ হারালে সাধারণত রিপোর্ট করে। কিন্তু এই ব্যাচটা তো ধুলোয়, আগাছার তলায়, আর যেটা পাওয়া গেছে তার সঙ্গে একটা ছেঁড়া জুতোও ছিল। ব্যাপারটা একটা নিখোঁজ অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তিনি সোজা হাঁটলেন স্কুলের লাইব্রেরির দিকে। ভিতরে বসে আছেন লাইব্রেরিয়ান মহুয়া সরকার, বয়স তিরিশের কোঠায়, সদ্য নিযুক্ত, সদা শান্ত ও সহৃদয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাকে ভালোবাসে, এবং নতুন স্যারের সঙ্গেও তার সদ্য একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

“ম্যাডাম, একটা ব্যাচ পেয়েছি স্কুলের পেছনে। নম্বর B-147। জানতে চাইছি, এই নম্বরটা কার ছিল… যদি কোনো ফাইল বা রেজিস্টারে থেকে থাকে।” মহুয়া ম্যাডাম সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ছাত্র রেকর্ড বের করে দেখাতে লাগলেন।

প্রথম কয়েকটা পাতায় কিছু নাম ঠিকানা দেখে অভীক মনে মনে ভাবলেন, কাজ সহজ হবে। কিন্তু পাতা উল্টাতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি।

একটা পাতার প্রায় অর্ধেক ছেঁড়া। ঠিক যেখানে ছাত্রদের নাম, রোল নম্বর, ব্যাচ নম্বর দেওয়া থাকার কথা, সেখানে ফাঁকা। দুজনেই চুপ। মিনিটখানেক নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলেন।

“আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি তো বলেছিলেন কয়েক মাস হলো এখানে যোগ দিয়েছেন, আগে তো অন্য কেউ ছিলেন?”
“হ্যাঁ স্যার, আগে ছিলেন দীপা দত্ত। উনি রিটায়ার করেছেন সম্প্রতি। চাইলেই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। আমার ফোনে নম্বর আছে।”

একটু দ্বিধা নিয়ে মহুয়া ম্যাডাম ফোন করলেন দীপা ম্যাডামকে।

“হ্যালো, দিদি? আমি মহুয়া, শান্তিপুর স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। একটা জিনিস জানতে চাচ্ছি। রেকর্ড ফাইলে একটা পাতায় ছেঁড়া আছে, একজন ছাত্রের তথ্য নেই। আপনি কিছু মনে করতে পারছেন?”

ওপাশ থেকে দীপা ম্যাডামের গম্ভীর গলায় উত্তর এল—

“প্রতিটি রেকর্ডের একটা করে কপি রাখা হত স্কুল কমিটির প্রধান চন্দন ঘোষের আলমারিতে। আমি নিয়ম করেই পাঠাতাম। যদি কোনো পৃষ্ঠা ছেঁড়া থাকে, তাহলে ওখানে খুঁজে দেখতে পারো।”

ফোনটা কেটে যেতেই অভীক চোখ তুলে মহুয়াকে বললেন, “চন্দন ঘোষ… উনি তো আগেই আমার উপর ক্ষেপে আছেন। ওনার আলমারি তো উনি নিজেই খোলেন না কাউকে… আমরা কীভাবে করবো?”

মহুয়া একটু ভাবলেন। তারপর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। “স্যার, আর পাঁচ দিন পর নেতাজীর জন্মজয়ন্তী। পুরো স্কুল অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকবে। চন্দন বাবুও তো অতিথিদের অভ্যর্থনায় মশগুল থাকবেন। ওটাই সুযোগ।”

অভীক তার প্রশংসা করলেন, “আপনার আইডিয়াটা দারুণ! যদি আপনি সাহস করে সঙ্গে থাকেন, তাহলে আমি যাব।”

মহুয়া ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

দিন গড়িয়ে এল নির্ধারিত তারিখ। সকাল থেকেই স্কুলে উৎসবের আমেজ। ছেলেমেয়েরা ইউনিফর্ম পরে লাইনে দাঁড়িয়েছে। হেডস্যার বক্তব্য দিচ্ছেন, মঞ্চে অতিথিদের অভ্যর্থনা চলছে।

এই সুযোগে অভীক আর মহুয়া স্কুল অফিসের পেছনের করিডোর দিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন চন্দনবাবুর ঘরে।

ঘরটায় ঢুকতেই একটা ভারী গন্ধ—পুরোনো কাগজ, কাঠের আলমারির পচা ধাঁচ।

“এই তো… এটা বুঝি?” অভীক দেখালেন লাল কাপড়ে মোড়া একটা ফাইল।

মহুয়া কাঁপা হাতে সেটি খুললেন। প্রথম কয়েকটা পাতায় পুরোনো বছরের ছাত্রদের তথ্য। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে মিল খেয়ে গেল—

নম্বর: B-147
নাম: রাহুল রামদিন
রোল নম্বর: ১৬৩
ঠিকানা: শান্তিপুর খনি কলোনি, বাড়ি নম্বর ৩২

তাদের দুজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মহুয়া ফিসফিস করে বললেন, “স্যার, রামদিন… এটা তো খনি এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে একটা খুব পরিচিত নাম…”

অভীক ব্যাচ আর জুতোর কথা মনে করলেন। তিনি ধীরে বললেন, “তাহলে স্কুলের পিছনের ঝোপে পড়ে থাকা জুতোটা সম্ভবত এই ছেলেটার… কিন্তু সে কোথায় গেল? কেউ জানে না?”

মহুয়া চোখ বড় করে বললেন, “আরেকটা বিষয় খেয়াল করলেন? রোল নম্বরের পাশে লেখা নেই ‘Passed’ বা ‘Transferred’। ওটা ফাঁকা…”

অভীক ফাইল বন্ধ করলেন। “এই গল্পের শুরু হয়েছে… কিন্তু শেষ কোথায় জানি না। তবে আমি থামবো না। এই ছেলেটার খোঁজ আমি পাবোই।”

মহুয়া জানালা দিয়ে অনুষ্ঠান চলতে দেখলেন। নেতাজীর বিরাট ফটোর পাশে অভীক স্যারের মুখটাও যেন একইভাবে দৃঢ়তায় জ্বলজ্বল করছে। মহুয়া মনে মনে বললেন, “স্কুলের ইতিহাসে হয়তো প্রথমবার কেউ একজন হারিয়ে যাওয়া ছাত্রের জন্য সত্যি জানার চেষ্টা করছে…”


পর্ব ৪ : অন্ধকারের অন্তরালে

রাহুল রামদিন নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল অভীকের। স্কুলের রেকর্ডে তার নাম আছে, ব্যাচ নম্বর আছে, কিন্তু কোথায় আছে সে এখন, তা কেউ জানে না। ছেঁড়া জুতো আর ব্যাচের পেছনে কী ভয়াবহ সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে, সেই উপলব্ধি করতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি।

মহুয়া ম্যাডাম তখন পাশে দাঁড়িয়ে। অভীক ধীরে বললেন, “ম্যাডাম, আমাদের এই ছেলেটার ব্যাপারে আরো কিছু খুঁজে বের করতেই হবে।”

তাদের অনুসন্ধান শুরু হয় স্থানীয় খনিশ্রমিকদের থেকে। শান্তিপুর খনির পাশে কিছু চা দোকান, কয়েকজন বৃদ্ধ শ্রমিক—যারা অনেক বছর ধরে কাজ করছেন, তাদের কাছে খোঁজ নেয় অভীক।

তাদের মুখে শোনা গেল, বছর পাঁচেক আগে এক রামদিন মণ্ডল নামের শ্রমিক বিহার থেকে এখানে এসেছিল কাজের খোঁজে। প্রথমে ভালো ছিল, কিন্তু পরে এক দলে পড়ে যায় যারা খনি বন্ধ হওয়ার পরে রাতের অন্ধকারে বেআইনি ভাবে কয়লা চুরি করত।

এক বৃদ্ধ বললেন, “ও রামদিন… ভালো মানুষ ছিল গো। কিন্তু টাকার লোভ বড় জিনিস। একদিন শুনি মদ খেয়ে নাকি খাদে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। কেউ দেখেনি, শুধু মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল খনির পেছনে।”

অভীক এবার জিজ্ঞেস করেন, “তার ছেলে ছিল না? স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল না?”
একজন উত্তর দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই সময় খনির মালিক বলে একজন বাচ্চাটাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। ছেলেটা শান্তিপুর হাইস্কুলে পড়ত। কিন্তু পরে শুনলাম রামদিনের ভাই এসে ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে বিহারে।”

অভীক আর মহুয়া একে অপরের দিকে তাকালেন।

“কিন্তু… আমরা তো রেকর্ডে পেয়েছি যে ছেলেটার কোনো ট্রান্সফার হয়নি। রোল নম্বরও বাদ পড়েনি। তাহলে?”

এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই অভীক ঠিক করলেন বিহার যাওয়া দরকার। স্কুল থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে, মহুয়াকে সঙ্গে নিয়ে তারা রওনা হলেন রামদিনের ঠিকানার দিকে। ট্রেনের সফর পেরিয়ে পৌঁছলেন বিহারের ছোট্ট শহর ছাতনিপাড়া

গ্রামে গিয়ে প্রথমে কেউ রামদিন মণ্ডল নাম শুনেই চমকে উঠল। এক বৃদ্ধা বললেন, “হ্যাঁ, রামদিন তো গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে কয়লার খনিতে কাজ করতে… অনেকদিন হয়ে গেল, তারপর কোনো খবর আসেনি। তার বউ আগেই মারা গেছে। একটা ছেলেই ছিল তার—রাহুল। ওকে নিয়েই তো রামদিন গিয়েছিল।”

অভীক দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন, “আপনারা জানেন না, রামদিন মারা গিয়েছেন?”

বৃদ্ধা চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন। তার ঠোঁট কাঁপতে লাগল। “কী বলছেন? কবে?”
অভীক বুঝলেন, এখানকার কেউ জানে না যে রামদিন আর বেঁচে নেই।

তাহলে সেই ছেলে—রাহুল—কে নিয়ে গেছে কে? রামদিনের ভাইয়ের কথা কেউ এখানে জানে না। কারণ রামদিনের কোনো ভাই নেই।

মহুয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “স্যার, তাহলে স্কুলে যে বলা হয়েছিল রামদিনের ভাই এসে বাচ্চাকে নিয়ে গেছে… সেটা কি বানানো?”

অভীক ধীরে মাথা নাড়লেন। সব কিছু যেন একটা ছায়ার জালে আটকে গেছে। কেউ যেন ইচ্ছে করেই একটা কাহিনি বানিয়ে সবাইকে ভুল পথে চালিত করেছে।

দুজনেই ঘরে ফিরে এলো গভীর ধাঁধা নিয়ে। ফিরে এসে অভীক আবার উঠলেন সেই ছাদে—যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিল। রাত গভীর, আকাশে মেঘ। একটা হালকা কুয়াশা জমছে। স্কুলের পিছনে কুয়োর দিকে তাকাতেই আবার সেই চাপা ফিসফিসে ডাক।

“স্যার…!”

হঠাৎ মনে হলো কে যেন ডাকছে। কিন্তু চারপাশে কেউ নেই।

অভীকের কাঁধে শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায়। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন—এই কুয়োর নিচে কোনো ভয়াবহ রহস্য চাপা পড়ে আছে। এবং সেই সত্যটা তাকে ডাকছে।

রাহুলের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, ব্যাচ নম্বর, ছেঁড়া জুতো, মিথ্যে গল্প—সব একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু সে সূত্রের জট খুলতে হলে নামতে হবে সেই ভয়ংকর অতলে… যেখানে রয়েছে এক মৃত আত্মার কান্না।

চোখে অদৃশ্য অঙ্গীকারের ঝিলিক নিয়ে অভীক ফিসফিস করে বললেন,
“তোমায় খুঁজে বের করবো রাহুল… আমি থামব না।”


পর্ব ৫ : কুয়োর তলায় চাপা সত্য

সকালের বাজারে অভীক স্যারের দেখা হয়ে গেল গৌর মাঝি-র সঙ্গে, যিনি পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী। হালকা শীর্ণ চেহারা, কাঁধে টুল-ব্যাগ ঝুলে আছে। সে হাসিমুখে বলল, “স্যার, আপনি যে আমাদের পেছনের মাঠটা ক্লিয়ার করালেন, এখন তো আমার ছেলে স্কুলে গিয়ে বেশ খেলা করতে পারছে।”

অভীক স্নিগ্ধ হাসলেন, “ওইতো, জয়, না? ওই তো বল হারাল, ওর জন্যই তো পুরো মাঠটা পরিষ্কার করা হলো!”

গৌর মাঝি হেসে মাথা নেড়ে বলল, “আরে স্যার, একটা কথা শুনেছেন? স্কুলের পেছনের কুয়োটা বুজিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ক’দিনের মধ্যে লোক এনে বাঁশ, সিমেন্ট, ইট সব চলে আসবে।”

আভীক থমকে গেলেন। “কুয়ো বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কে অর্ডার দিয়েছে?”

গৌর মাঝি উত্তর দিল, “কমিটির হেড চন্দন বাবু। শুনেছি ওনিই ঠিক করেছেন—পুরো কুয়োটাই নাকি বিপদজনক।”

অভীকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এই তো কিছুদিন আগেই চন্দন ঘোষ তাকে বলেছিলেন, স্কুলে বাজেট নেই—জঙ্গল পরিষ্কার করা যাবে না। অথচ এখন সেই মানুষটাই কুয়ো বুজিয়ে দেওয়ার মতো খরচাসাপেক্ষ কাজ করছেন? সন্দেহ ঘনীভূত হলো।

অভীক ফিরেই ফোন করলেন তার পুরনো বন্ধু এসআই দীপঙ্কর মিত্র-কে। এলাকার থানায় সদ্য পোস্টিং হয়েছে তার। দীপঙ্কর অভীককে ভালোভাবে চেনে এবং তার কথাও গুরুত্ব দিয়ে শোনে।

সব শুনে দীপঙ্কর বললেন, “তুমি বলছ যদি সত্যি কিছুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, তবে কুয়ো খনন করে দেখা দরকার। আমি অনুমতি আদায় করে নিচ্ছি।”

দুদিন পর খনন কাজ শুরু হয়। স্কুল ছুটির পর সময়ে সব আয়োজন করা হয়। ইট তুলে, ঘাস সাফ করে ক্রেন নামানো হয় ভিতরে। প্রায় তিন ঘন্টা খননের পর হঠাৎ একটি ক্রেনের ঝুড়িতে উঠে আসে মানব কঙ্কাল

সকলের মুখ ফ্যাকাশে।

দীপঙ্কর কিছুক্ষণের মধ্যেই সিআইডি ও ফরেনসিক দল ডেকে আনেন। কঙ্কালটি শিক্ষকের হাতে পাওয়া ব্যাচ নম্বর, ছেঁড়া জুতো এবং স্কুল রেকর্ডের সূত্র ধরে সন্দেহ করা হয়—এটি রাহুল রামদিনের দেহাবশেষ।

অভীক বলেন, “রামদিনের মৃত্যু হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিশ্চয় হসপিটালে আছে। তার DNA-এর সাথে যদি কঙ্কালের DNA মেলানো যায়, তাহলে প্রমাণ মিলবে।”

ফরেনসিক টিম দ্রুত স্যাম্পল সংগ্রহ করে। বিশ্লেষণ রিপোর্ট আসে দুই দিনের মধ্যে।

১০০% DNA ম্যাচ।

কোনো সন্দেহ নেই—এই কঙ্কাল রাহুল রামদিনের।

তদন্ত শুরু হয় স্কুল কমিটির হেড চন্দন ঘোষকে কেন্দ্র করে। প্রথমে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। কিন্তু একে একে তথ্য তুলে ধরলে ও প্রতিটি প্রশ্নে জড়াজড়ি হয়ে অবশেষে তিনি ভেঙে পড়েন।

চন্দনের স্বীকারোক্তি:

“রামদিন আমাদের সঙ্গে কয়লা বেচাকেনার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়েছিল। মালিক শিবনাথ সিংহ, আমি আর সে মিলে রাতের অন্ধকারে কয়লা তুলে বিক্রি করতাম। ওর পাওনা টাকা ঠিকমতো দিতাম না। একদিন ঝগড়া বাধে। রামদিন বলেছিল—সব ফাঁস করে দেবে। তাই রাতে এক ফাঁকে তাকে খাদে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলা হয়।

তার ছেলে রাহুল কিছুই জানত না। তবে একদিন স্কুলে এসে আমাদের মধ্যে কথা শুনে ফেলে। ভয় পেয়ে যায়, কিছু বলার আগেই আমি আর শিবনাথ মিলে ওকে তুলে এনে পেছনের কুয়োতে ফেলে দিই। পরে ছড়ানো হয়, রাহুলকে রামদিনের ভাই বিহারে নিয়ে গেছে।”

কান্নায় ভেঙে পড়েন চন্দন।

শিবনাথ সিংহও ধরা পড়ে পুলিশের জালে। অপরাধের স্বীকৃতি দেয়।

খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা এলাকায়। সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন, সবাই এসে ভিড় জমায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা—রাহুলের আত্মা যেন শান্তি পায়।

দুদিন পর স্কুল ছুটির পরে, অভীক আর মহুয়া স্কুলের সেই কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। চুপচাপ।

চন্দনের স্বীকারোক্তি অভীকের চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে –

রাহুল, শান্ত, মেধাবী আর চুপচাপ সবার প্রিয় এক ছেলে। বাবা রামদিনের মৃত্যু নিয়ে সে কিছুই জানত না, কেবল জেনেছিল—বাবা হঠাৎ করেই খনিতে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু সেই মৃত্যুর পেছনে যে কতটা অন্ধকার, তা জানার সুযোগ পায়নি সে… অন্তত শুরুতে।

একদিন স্কুলের শেষে বিকেলের দিকে, ছাত্ররা তখন অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। রাহুল তার ছাতা ভুলে যাওয়ায় ফিরে এসেছিল শ্রেণিকক্ষে। তখনই স্কুলের অফিস ঘরের দরজাটা সামান্য খোলা ছিল। ভেতরে কমিটির হেড চন্দন ঘোষ আর খনির মালিক শিবনাথ সিংহ কথা বলছিল।

চন্দন বলছিল, “আপনি যেভাবে রামদিনকে ঠেলে দিলেন খাদে, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি ঠিক কাজই করেছেন। বেয়াদবটা যদি মুখ খুলত, আমরা তো ধরা পড়ে যেতাম।”

শিবনাথ গলা নামিয়ে বলল, “তাই তো বলছি, চুপছাপ থাকো, কেউ যেন এসব কথা জানতে না পারে।”

এই কথাগুলো পরিষ্কারভাবে শুনে ফেলেছিল দরজার পাশে দাঁড়ানো রাহুল।

ভয়ে তার গা কাঁপতে থাকে। চোখে জল চলে আসে। তার ছোট্ট বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সে জানত না কী করবে, কার কাছে যাবে।

সে চুপচাপ সরে পড়ে, কিন্তু তাকে দেখতে পেয়ে যায় শিবনাথ। চন্দন রাহুলকে দেখে ভয় পেয়ে যায়, এই বুঝি সব শেষ হতে চলেছে।

দুজনে একসঙ্গে ধমকে ওঠে, “দাঁড়া রাহুল!”

রাহুল দৌঁড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যায়। দুজনে মিলে ছেলেটাকে পেছনের ফাঁকা জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যায়। রাহুল কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আমি কাউকে কিছু বলব না… প্লিজ… আমায় যেতে দাও…”

কিন্তু তাদের মনুষ্যত্ব তখন মৃত।

চন্দন ফিসফিস করে বলে, “এখনই শেষ না করলে কাল খবরের কাগজে আমরা ছবি হয়ে যাব!”

বাচ্চাটাকে গলা টিপে খুন করে তারপর তাকে নিয়ে গিয়ে ঠেলে ফেলে দেয় সেই অন্ধকার কুয়োর গভীরে।

একটি ছোট্ট শরীরের ঝপ করে শব্দ হয়… তারপর সব নিস্তব্ধ।

শিবনাথ বলে, “এখন খবরে ছড়াতে হবে — রামদিনের ভাই বিহার থেকে এসে এই ছেলেকে নিয়ে গেছে। কেউ সন্দেহ করলেই বলবি গ্রামের বাড়ি গেছে।”

চন্দন মাথা নাড়ে।

তারপর থেকে প্রতিটি প্রশ্নের মুখে ওই মিথ্যে গল্প সাজিয়ে বলত তারা। কেউ আর খোঁজ করেনি, কারণ পরিবারও ছিল না আশেপাশে। আত্মীয়স্বজন কেউ এখানে ছিল না রাহুলের।

…………………………………

“স্যার…” মহুয়ার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় অভীক। মহুয়া বলে, “আমরা একটা শিশুর আত্মাকে মুক্তি দিতে পারলাম।”

একটা সাদা খরগোশ অভীকের পায়ের কাছে এসে আনন্দে খেলা করতে থাকে। মহুয়া বলে, “চলুন স্যার, আমরা এবার যাই, এখানে আর কোনো অতৃপ্ত আত্মা নেই। ঐ দেখুন গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। পাখিরা আবার বাসা বাঁধা শুরু করেছে। এটাই প্রমাণ করে রাহুলের আত্মা শান্তি পেয়েছে।”

দুজনে ধীর পায়ে ওখান থেকে ফিরে আসে।


আপনার মতামত দিন